আধুনিক উপায়ে বেগুন চাষ পদ্ধতি

আধুনিক উপায়ে বেগুন চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে আপনি যদি বিস্তারিত ভাবে না জেনে থাকেন। তাহলে আজকের এই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ ভাবে পড়লে আপনি জানতে পারবেন আধুনিক উপায়ে বেগুন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।আমাদের দেশে যত রকমের সবজি আছে এদের মধ্যে বেগুন অন্যতম। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতে কম বেশি বেগুন চাষাবাদ হয়ে থাকে।
আধুনিক উপায়ে বেগুন চাষ পদ্ধতি


কিন্তু আমাদের অনেকেরই বেগুন চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানিনা। বেগুন চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে না জানার কারণে অনেক চাষী ভাইরা লোকসানের সম্মুখীন হয় বা লাভবান হয় না। এজন্য আমি আপনাদের জন্য আধুনিক উপায়ে বেগুন চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক আধুনিক উপায়ে বেগুন চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে।

বেগুনের জাতসমূহ

আমাদের দেশে সারা বছরই বেগুনের চাষ করা হয়। কিন্তু অনেকেরই জানা নেই কোন সময়ে কোন জাতের বেগুন চাষ করলে অধিক ফলন ও লাভবান হওয়া যায়। বেগুনের ফলন বৃদ্ধি ও লাভবান হওয়ার জন্য ভালো মানের বা ভাল জাতের বীজ নির্বাচন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মৌসুমী ভিত্তিতে বেগুনের জাত গুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় যেমন শীতকালীন জাত ও বারোমাসি জাত। শীতকালীন বেগুন শুধুমাত্র রবি মৌসুমে চাষ করা হয়, কারণ এই বেগুনগুলো শীতকালে বেশি ফলন দিয়ে থাকে। আর বারোমাসি জাতের বেগুনগুলো সারা বছর চাষ করা হয়

বেগুন চাষের মৌসুম

বাংলাদেশের জলবায়ুতে বছরে যেকোনো সময় বেগুন চাষাবাদ করা যায়। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে বেগুন চাষের পদ্ধতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন রবি মৌসুম/শীতকালীন সবজি ও খরিপ মৌসুম/বর্ষাকালীন সবজি।

রবি মৌসুমের জন্য সাধারণত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। খরিফ মৌসুমের জন্য সাধারণত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বীজ বপণের উপযুক্ত সময়। তবে রবি মৌসুমে যে কোন জাতের বেগুন লাগানো যেতে পারে, এবং খরিফ মৌসুমে চাষের জন্য শুধুমাত্র বারোমাসি জাতসমূহ লাগাতে হবে।

শীতকালীন জাত

যেসব জাতের বেগুনগুলো শীতকালে বা রবি মৌসুমে চাষাবাদ করা হয় সেগুলো হলঃ ইসলামপুরী, খটখটিয়া , লাফফা, ঈশ্বর এক, উত্তরা(বাড়ি বেগুন এক) ইত্যাদি।

খরিফ মৌসুম জাতসমূহ

যে সকল বেগুনের জাত সমূহ বছরের বিভিন্ন সময়ে চাষাবাদ করা হয়ে থাকে সেগুলোকে আমরা বারোমাসি জাত বলে থাকি।বারোমাসি জাতের বেগুনগুলো হলোঃ তাল বেগুন বা তল্লা বেগুন, শিং নাথ, ঝুমকো ডিম বেগুন মুক্তকেশী, শুকতারা, তারাপুরী(বাড়ি বেগুন ২) কাজলা(বাড়ি বেগুন ৪) নয়ন তারা(বাড়ি বেগুন ৫) বিজয় ইত্যাদি

বেগুন গাছে ধরণ

বেগুনের জাতের উপর ভিত্তি করে বেগুন গাছ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। সাধারণত বেগুন গাছ (২-৩) ফিট পর্যন্ত লম্বা হয়। বেগুন গাছ ঝাঁপটি মত হয়। বেগুন গাছের পাতা সবুজ রঙের হয় এবং ফুল সাদা ও হালকা বেগুনি রোগের হয়ে থাকে। বেগুন গাছের অনেক শাখা প্রশাখা থাকে।

বীজতলা তৈরি

বেগুন চাষের জন্য প্রথম পর্যায়ে বেগুনের চারা উৎপাদন করতে হয়। এই চারা উৎপাদনের জন্য প্রথমে বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজতলা তৈরির জন্য প্রথমে উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন করতে হবে যেখানে আলো বাতাস পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায় এবং বীজতলায় যেন পানি বেঁধে না থাকে এমন জায়গায় প্রথমে মাটি ভালোভাবে চাষ দিতে হবে। বীজ তলার মাটি উর্বর হতে । বীজ তলা তলার মাটি যদি উর্বর না থাকে তাহলে জৈব সার ও সামান্য পরিমাণ ফসফেট জাতীয় সার ব্যবহার করা যেতে পারে।

বীজতলা চাষের পর জমি কে কয়েকটি ছোট ছোট স্তরে ভাগ করে নিতে হবে এবং দুটো বীজতলার মাঝে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গা রাখা উচিত। এবং বীজ তলার দুপাশের মাটি দিয়ে উঁচু করে দিতে হবে যেন পানি জমে না থাকে।বীজ তলায় চারা বপণের পর , বীজতলার চারপাশ ভালোভাবে বেড়া দিতে হবে যেন পশুপাখি বীজতলার মধ্যে ঢুকতে না পারে। বীজ বপনের পর বীজতলায় হালকাভাবে পানি দিতে হবে।

জমি তৈরি ও চারার রোপণ

সাধারণত বেগুন চাষের জন্য বেলে দোআঁশ, দোআঁশ এবং এটেল মাটি অত্যন্ত উপযোগী। বেগুন চাষের জন্য জমি কে ৪-৫ বার চার্জ দিতে হবে মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুর করে নিতে হবে। চাষের সময় জমিতে প্রয়োজনমতো সার ব্যবহার করতে হবে। তারপর বেগুনের চারা লাগানোর জন্য জমিতে বেড তৈরি করতে হবে। বেডে আকার সাধারণত৬০-৯০ সেন্টিমিটার হবে। বেগুনিয়ে চড়ার বয়স৩৫-৪৫ দিন হলে চারারোপণের উপযোগী হয়।



এ সময় ছাড়াতে৫-৬ একটি পাতা গজায় এবং চারা পীরায় ১৫ সেমি লম্বা হয়। চারা তোলার সময় শিকড় যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত এজন্য চারা তোলার এক থেকে দুই ঘন্টা আগে বীজ তলায় পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে। জমিতে চারারোপণের সময় প্রত্যেকটি চারা ৫০ সেন্টিমিটার থেকে ৬০ সেন্টিমিটারে ব্যবধানে লাগাতে হবে। জমিতে চারা রোপনের পরপরই চারা যেন শুকিয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত।

সার প্রয়োগ

বেগুন মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে। এজন্য ভালো ফলনের জন্য বেগুন গাছে প্রয়োজন অনুযায়ী সার ব্যবহার করতে হবে নতুবা ভালো উৎপাদন সম্ভব নয়। মাটির গুনাগুন এর উপর ভিত্তি করে জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে। বেগুন চাষের জন্য হেক্টর প্রতি যে পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে। সে সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো


ইউরিয়া সার ৩০০ কেজি, টিএসপি ২৫০ কেজি, এমপি২০০ কেজি , ফসফেট২০০ কেজি ইত্যাদি এগুলো তিন কিস্তিতে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। প্রথমে চারা লাগানোর ১০-২৫ দিন পর, দ্বিতীয় বেগুন গাছে ফল ধরা শুরু হল, তৃতীয় বেগুন তোলার মাঝামাঝি সময়ে দিতে হবে। জমিতে রস না থাকলে সার প্রয়োগের পর পরই সেচ দিতে হবে

রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা

বেগুন চাষে সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে পোকা ও রোগ। আপনি যদি সঠিকভাবে বেগুন গাছে কীটনাশক প্রয়োগ করতে না পারেন তাহলে সহজেই বেগুন গাছে রোগে আক্রমণ করতে পারে যা বেগুন গাছের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।


বেগুন গাছের কান্ড ফল পচা রোগের জন্য কার্বন ডাইজিম জাতীয় কীটনাশক(যেমন নোইন অথবা এইমকোজিম২০ গ্রাম) প্রতি১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি৫ শতকে১২-১৫ দিন পর পর২-৩ বার ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। গোড়া পচা রোগের জন্য ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে যেন মাটি ভিজে যায়। জাব পোকা ও জ্যাসিড দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জ্তীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা

বেগুনের সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হলো বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। জাব পোকা, এছাড়াও বিছা পোকা পাতা মড়ানোপোকা ইত্যাদি বেগুনের ক্ষতি করে থাকে । আইপি এম পদ্ধতিতে এসব পোকা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

সেচ ও পরিচর্যা

বেগুন গাছে প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন হয়। এজন্য বেগুন গাছে প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়মিত পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পানি দেয়ার সময় খেয়াল রাখা জরুরি যেন জমিতে পানি বেঁধে না থাকে। কারণ বেগুনের জমিতে পানি বেধে থাকলে বেগুন গাছ মারা যাবে এজন্য পানি দেয়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন জমিতে পানি বেঁধে না থাকে।

পরিচর্যা

বেগুন চাষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে বেগুনের জমি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা। যেন জমিতে আগাছা না জন্মে। কারণ বেগুনের ফলন অনেকাংশে নির্ভর করে জমি সঠিকভাবে পরিচর্যার উপরে। জমির মাটি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিলে বেগুন গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সতেজ থাকে যা বেগুন গাছের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে যেন জমিতে কোন আগাছা না জন্মে। আগাছা দেখা দিলে সাথে সাথে পরিষ্কার করে রাখুন

বেগুন সংগ্রহ

বেগুন গাছ থেকে বেগুন খাওয়ার উপযোগী হলে তা সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু সংগ্রহ করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন অপরিপক্ক বেগুন না তুলি। লক্ষ্য রাখতে হবে যে বেগুন তোলার সময় যেন বেগুন গাছে আঘাত না লাগে। আপনি যদি সঠিক নিয়মে বেগুনের জমি এবং গাছের পরিচর্যা করতে পারেন তাহলে জাত ভেদে হেক্টর প্রতি ২০-৭০ টন পর্যন্ত ফলন পেতে পারেন।
আধুনিক উপায়ে বেগুন চাষ পদ্ধতি


শেষ কথা

উপরোক্ত বিষয়গুলো মেনে যদি কোন চাষী ভাই সঠিকভাবে সঠিক নিয়মে বেগুন চাষের পদ্ধতি বুঝিয়ে চাষ করতে পারেন।তাহলে আমার মনে হয় আপনি যথেষ্ট লাভবান হবেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url